ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান শাহ
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে ক্ষুধা ও দারিদ্র মুক্ত সোনার বাংলায় রূপান্তরের প্রচেষ্টায় কৃষিকে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে মূল্যায়ন করেছেন। কৃষিতে বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা অপরিসীম। কৃষির উন্নতি ও মেধাবীদের কৃষিতে অন্তর্ভুক্তির জন্য তিনিই কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণীর পদমর্যাদা দেন। পরবর্তীতে তাঁর সুযোগ্য কন্যা বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন “সোনার বাংলা” গড়ার প্রত্যয়ে বদ্ধপরিকর। জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রায় ১৭ কোটি মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় ধান-গমের পাশাপাশি খাদ্য তালিকায় ভুট্টার ব্যবহার যেমন মিষ্টি ভুট্টা, খই ভুট্টা, বেবি কর্ণ ইত্যাদি নতুন সংযোজন।
বর্তমান করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিতে খাদ্য সংকট যাতে না হয় সরকার সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রেখেছেন। কিন্তু ভুট্টা উৎপাদনে নতুন একটি অন্তরায়, বিধ্বংসী পোকা ফল আর্মিওয়ার্ম (ঋধষষ অৎসুড়িৎস)। যার আক্রমণে ভুট্টার পুরো ফসল নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এই পোকা ভুট্টা ছাড়াও ধান, সরগাম, আখ, তুলা ও সব্জি জাতীয় ফসলসহ ৮০টিরও বেশী ফসলে আক্রমণ করে। তাই বর্তমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে খাদ্য সংকোট মোকাবেলায় ফল আর্মিওয়ার্ম দমন ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত তাৎপর্য বহন করে।
ফল আর্মিওয়ার্ম (ঋধষষ অৎসুড়িৎস) খবঢ়রফড়ঢ়ঃবৎধ বর্গের একটি পোকা যার বৈজ্ঞানিক নাম ঝঢ়ড়ফড়ঢ়ঃবৎধ ভৎঁমরঢ়বৎফধ ঔ.ঊ ঝসরঃয। এটি প্রধানত উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার পোকা হলেও বর্তমানে এর বিস্তৃতি বিশ্বব্যাপী লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ২০১৬ সালে আফ্রিকা মহাদেশে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশ এবং চীনসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এটি ছড়িয়ে পড়ে।
ফল আর্মিওয়ার্ম চেনার উপায়
ফল আর্মিওয়ার্ম পোকার লার্ভার শরীরের অষ্টম খÐাংশের উপরের দিকে চারটি সুস্পষ্ট কালো ফোটা বিদ্যমান, যা বর্গাকৃতি আকারে সজ্জিত থাকে। লার্ভার সম্মুখভাগে সাদা উল্টা ‘ণ’ এর মত চিহ্ন থাকে। ফল আর্মিওয়ার্ম পোকার পুরুষ এবং স্ত্রী মথের বাহ্যিক অবয়বে সুস্পষ্ট পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। পুরুষ এবং স্ত্রী উভয় মথের পেছনের পাখা সিলভারি সাদা রঙের। তবে পুরুষ মথের সামনের পাখায় সাদা দাগ থাকে কিন্তু স্ত্রী মথের পাখায় কোন সাদা দাগ থাকে না।
ক্ষতির প্রকৃতি
ফল আর্মিওয়ার্ম পোকার পূর্ণাঙ্গ মথ অনেক দূর পর্যন্ত উড়ে যেতে পারে বিধায় এদের প্রাদুর্ভাব দ্রুত এক অঞ্চল হতে অন্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি, এক রাতে এরা ১০০ কিমি. পর্যন্ত উড়তে সক্ষম এবং পুত্তলি থেকে পূর্ণাঙ্গ মথ হওয়ার পর ডিম পাড়ার পূর্বেই ৪৮০ কিমি. পর্যন্ত স্থানান্তরিত হয়।
এরা সাধারণত দলবদ্ধভাবে এক ফসল থেকে অন্য ফসলে আক্রমণ করে। এই পোকার কীড়া ভুট্টা গাছের কচি পাতা ও কচি মোচার ভেতরের ভুট্টার দানা খেয়ে থাকে। ডিম থেকে কীড়া বের হওয়ার পরপরই দলবদ্ধভাবে কচি পাতার সবুজ অংশ কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়ে ছোট ছোট গোলাকার জালিকার ছিদ্র করে, যাকে ডরহফড়ঢ়িধহ বলে।
পরবর্তীতে কীড়া বড় হওয়ার সাথে সাথে ভুট্টা গাছের ডগার ভেতর ঢুকে পড়ে ও ডগার ভেতরের কচি পাতা খেয়ে (ওহভবংঃবফ যিড়ৎষ) গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত করে।
মোচা ধরা পর্যায়ে আক্রমণ করলে ভুট্টার কচি মোচা ছিদ্র করে ভেতরে প্রবেশ করে এবং ভ্ট্টুার দানা খেয়ে ফেলে, ফলে ফলন কমে যায়।
আক্রান্ত গাছে ভেজা লাল-বাদামি রঙের পোকার মল দেখা যায়। কীড়ার ৪র্থ থেকে ৬ষ্ঠ ধাপ (ওহংঃধৎ) অবস্থায় খাদ্য চাহিদা অত্যন্ত বেড়ে যায় এবং এক রাত্রের মধ্যে পুরো ফসল বিনষ্ট করতে পারে।
সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা
সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনাই ফল আর্মিওয়ার্ম দমনের জন্য কার্যকর পদ্ধতি। এজন্য নি¤েœাক্ত ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করতে হবে।
ভুট্টা বীজ কীটনাশক দিয়ে শোধন করে জমিতে বপন করতে হবে। প্রতি কেজি ভুট্টা বীজের সাথে ২.৫ মিলি ফরটেনজা এবং ৪ মিলি পানি পলিব্যাগে একসাথে প্রায় ১মিনিট ভালোভাবে ঝাঁকাতে হবে যাতে বীজের গায়ে প্রলেপ পড়ে। এর পর আধঘণ্টা ছায়াযুক্ত স্থানে শুকিয়ে ঐদিনই জমিতে বীজ বপন করতে হবে।
ভুট্টার সাথে আন্তঃফসল হিসেবে যথাসম্ভব শিম (খবমঁসব) জাতীয় ফসল চাষাবাদ করতে হবে। একই জমিতে বার বার ভুট্টা চাষ পরিহার করতে হবে। ভুট্টার চারা গজানোর সাথে সাথে খাওয়ার লক্ষণ বা মল দেখে পোকার আক্রমণ চিহ্নিত করতে হবে এবং আক্রমণের মাত্রা নির্ণয় করতে হবে।
ফেরোমন ফাঁদ (প্রতি একর জমিতে ৩-৪টি) ব্যবহার করেও ফল আর্মিওর্য়াম পোকার উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। সম্ভব হলে আক্রান্ত গাছ হতে ডিম বা সদ্য প্রস্ফুটিত দলবদ্ধ কীড়া চিহ্নিত করে মেরে ফেলতে হবে কিংবা মাটির এক ফুট গভীরে পুঁতে ফেলতে হবে। আক্রান্ত ফসলে জৈব বালাইনাশক যেমন এসএফএনপিভি (স্পোডোপটেরা ফ্রুজিপারডা নিউক্লিয়ার পলিহেড্রোসিস ভাইরাস) বা এসএনপিভি (স্পোডোপটেরা নিউক্লিয়ার পলিহেড্রোসিস ভাইরাস) প্রতি লিটার পানিতে ০.২ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। এভাবে ৭ দিন পর পর ২-৩ বার গাছ ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।
ট্রাইকোগ্রামা এবং ব্রাকন নামক উপকারী পোকা ভুট্টা ফসলে অবমুক্ত করা যেতে পারে। আক্রান্ত ফসলে সেচ দেয়ার সময় যথাসম্ভব প্লাবন সেচ দিতে হবে। আক্রমণের মাত্রা শতকরা ২০ ভাগ বা তার অধিক হলে রাসায়নিক কীটনাশক যেমন স্পিনোসাড্ (ট্রেসার ৪৫ এসসি প্রতি লিটার পানিতে ০.৪ মিলি বা সাক্সেস ২.৫% এসসি প্রতি লিটার পানিতে ১.৩ মিলি হারে) বা এমামেকটিন বেনজোয়েট (প্রোক্লেম ৫ এসজি প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম হারে) বা ক্লোরেনট্রানিলিপ্রোল (কোরাজেন ১৮.৫% এসসি প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি হারে) বা ফ্লুবেনডায়ামাইড (বেল্ট ২৪ ডবিøউজি প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম হারে) আক্রান্ত ভুট্টা ফসলে সুরক্ষা সরঞ্জাম পরিহিত অবস্থায় স্প্রে করতে হবে।
সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ভুট্টার ফল আর্মিওয়ার্ম দমন করি বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করি। য়
ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, কীটতত্ত¡ বিভাগ, বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট, নশিপুর, দিনাজপুর-৫২০০। মোবাইল-০১৭১২৫৬১৫৯২। ওয়েবসাইট: www.bwmri.gov.bd